উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম-সুপ্রিয়া বা উত্তম-সাবিত্রী। এই নামগুলি নিয়ে চর্চা, আলোচনা বা সমালোচনা আগেও হতো, এখনও হয়, হয়ত আগামী দিনেও হবে। এঁরা সবাই ছিলেন উত্তম কুমারের সিনেমার নায়িকা। কিন্তু অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে নায়ক উত্তম কুমার হয়ে ওঠার পিছনে বাস্তবের যিনি নায়িকা ছিলেন তাঁর কথা কোথাও সেভাবে আলোচনা হয় না। উত্তম প্রেমীরা হয়ত তাঁর কথা বিস্মৃত হয়ে গেছেন । তিনি গৌরী দেবী। উত্তম ঘরণী (wife of Uttam Kumar) ।
যাঁকে ভালোবেসে বিয়ে করে সংসার পেতে ছিলেন বাংলা সিনেমার মহানায়ক। যখন তিনি শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন তখনও তাঁর পাশে ছিলেন গৌরী দেবী । আবার সাফ্যলের সর্ব শেষ শিখরে পৌঁছানোর পরও হাত শক্ত করে ধরে রেখে ছিলেন। কিন্তু এই সুখের সংসারে একদিন উইপোকা বাসা বাঁধল। ক্রমে একদিন ধসে পড়ল সেই সংসার। কীভাবে ? শোনাব সেই কাহিনী ।
ল্যান্সডাউন রোডের এক অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা ছিলেন গৌরী দেবী । তিনি ছিলেন উত্তম কুমারের জ্যাঠতুতো বোন অন্নপূর্ণার বান্ধবী। সেই সূত্রেই বাড়িতে যাতায়াত । প্রতিমার মতো গোলগাল মুখ, মিষ্টি হাসির অধিকারিনী গৌরীকে দেখে ভালো লেগে গেল অরুণ কুমারের। তখন তিনি একটি সংস্থায় সামান্য মাইনের কেরানি। নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সিনেমা পাড়ায় যাতায়াত শুরু করেছেন। আর গোপন প্রেম চলছে গৌরীর সঙ্গে । ভারত তখন সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে। সেই যুগে প্রেম বিবাহ রক্ষণশীল পরিবারে কতটা স্বীকৃতি মিলবে, তা নিয়ে দু’জনেই চিন্তিত।
তবে একটা কথা আছে না, ইচ্ছা শক্তি প্রবল হলে কোনও বাধাই আর বাধা নয়। অনেক লড়াইয়ের পর উত্তম কুমারের প্রথম সিনেমা মুক্তি পেল। নাম দৃষ্টিদান। ঠাকুমাকে সঙ্গে নিয়ে গৌরী হলে সিনেমাটি দেখতে গেলেন। ঠাকুমা কিছুটা পরীক্ষা আবার কিছুটা মজার ছলে প্রশ্ন করলেন- কোন ছেলেকে পছন্দ হচ্ছে দিদিভাই? গৌরী পর্দায় উত্তমের দিকে আঙুল দেখালেন। সন্দেহ আগেই ছিল। এবার তা পোক্ত হল । গৌরীর বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ হল । ভালোবাসায় সাময়িক বিচ্ছেদ এল। কারণ দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। তবে বোন অন্নপূর্ণার মাধ্যমে খবর দেওয়া নেওয়া চলতে থাকল। ঠিক যেন সিনেমার গল্প । একদিন খবর এল গৌরীর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে বাড়ির লোক। আর কোন বাধা থাকল না। ছুটে গেলেন উত্তম কুমার। মনের জোর নিয়ে গৌরীর বাবার সামনে দাঁড়ালেন । অনেক বিবাদ, অনেক বিতণ্ডা। অবশেষে কাঁটা বিচ্ছানো পথ পেরিয়ে ভালোবাসা পরিণয় পেল।
wife of uttam kumar
১লা জুলাই ১৯৪৮। গঙ্গোপাধ্যায় থেকে চট্টোপাধ্যায় হলেন গৌরী দেবী। সাদা গাড়িতে চেপে বিয়ে করতে এলেন ঊত্তম কুমার। তখন তিনি রোগাপাতলা যুবক। সদ্য দু’টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। সবার মতো দৌড়ে এসে বারান্দা থেকে বর দেখতে এসে ছিলেন গৌরী। শেষে মায়ের বকুনি খেয়ে ফিরে যান। চার হাত এক হল। বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন অরুণ। ঘরে যেন লক্ষ্মী এলেন। সেই থেকেই উত্তমের বাড়ির লক্ষ্মী পুজোয় প্রতিমার মুখ গৌরীর আদলে শুরু হয়ে ছিল। যা আজও চলছে। বিয়ের পর শুরু হল অন্য সংগ্রাম । চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি সিনেমায় মন দিলেন উত্তম কুমার। ভরসা দিলেন গৌরী। মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার টাকা ছিল না। গয়না বিক্রি করে স্বামীর হাতে অর্থ তুলে দিলেন তিনি। জানতে দেননি বাপের বাড়িতে। আস্তে আস্তে নায়ক থেকে মহানায়ক হলেন উত্তম কুমার। দুবছর পর কোলে এল পুত্র সন্তান গৌতম । শ্বশুর- শাশুড়ি, দেওর, ননদ নিয়ে গৌরীর ভরা সংসার । ঠিক যেন হর – গৌরীর সংসার ।বাজারে তখন শুধুই উত্তম-সুচিত্রা। নানা রটনা, জল্পনা, রসের গল্প ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। যার কিছু কিছু গৌরীর কানেও আসত । ক্রমে মনে দানা বাঁধতে লাগল সন্দেহ। সন্দেহের বিষবৃক্ষ বেড়ে গেল যখন উত্তম কুমারের জীবনে এলেন সুপ্রিয়া চৌধুরী। একদিন অশান্তি চরমে উঠল । ঘর ছেড়ে সুপ্রিয়ার কাছে আশ্রয় নিলেন মহানায়ক। তারপরের কাহিনী সবার জানা। কিন্তু অন্য মহিলার সঙ্গে থাকলেও স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য কোনও দিন ভুলে যাননি তিনি। বিবাহ বার্ষিকীতে গিন্নিকে সোনার হার উপহার দেওয়া থেকে সংসারের সব দায়িত্ব শেষ দিন পর্যন্ত পালন করেছেন। আর স্বামী ঘর ছাড়া হলেও তাঁর প্রতি ভালোবাসা গৌরীর কোনদিন কমেনি। মহানায়কের মৃত্যুর পর হাত ধরে তাঁর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। স্বামী যখন চিতায়। তখন একমাথা সিঁদুর নিয়ে বলেছিলেন , ওর থেকে বেশিদিন আমাকে দূরে থাকতে হবে না। এক বছরের মধ্যেই আমাকে ও ডেকে নেবে!
বাস্তবে সত্যি হয়েছিল তাই। উত্তম কুমারের প্রয়াণের একবছরের মধ্যেই চলে যান গৌরী দেবী !
No comments:
please do not enter any spam link in the comment box